জন্মদিন নিয়ে আমার কখনোই খুব একটা উচ্ছ্বাস ছিল না। সেজন্য ঘটা করে জন্মদিন পালন কখনোই করা হয়নি। তথাপি পরিবার, প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধবদের কল্যাণে টুকটাক কেক-টেক কাটাকাটি প্রায়ই হয়েছে। অবশ্য বিয়ের পর থেকে ব্যাপার গুলো অন্যরকম। বিশেষ বিশেষ দিনের ব্যাপারে আমি একেবারে উদাসীন হলেও তাহসিন কখনো ভুল করেও কোন কিছু ভুলে না। অগত্যা আমিও এখন অল্পস্বল্প তাহসিন এবং পরিবারের সকলের উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হই, এবং এই উচ্ছ্বাস ভালই লাগে।
আমাদের প্রাত্যহিক ব্যাস্ততা ছাপিয়ে জীবনকে উপভোগ করবার মত আর এমন কিইবা উপলক্ষ আমরা পাই! তাহসিন এর যুক্তি হল সেই উপলক্ষগুলোও যদি আমরা সুযোগমত ব্যাবহার করতে না পারি তাহলে জীবনটা একেবারে ম্যারমারা এবং বিষাদ হয়ে যাবে। কথা সত্য। তাহসিনের দিবস উদযাপনের পক্ষের শক্তির শক্তি এখন অনেক বেশি। কারণ আরওয়া তার সাথে যুক্ত হয়েছে, এবং তাহসিন যা যা পারেনি সে ক্রমান্বয়ে সেগুলো করবার/ আদায় করে নেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। মেয়েটা আমার বড় হচ্ছে।
তাহসিন বরাবরই অঘটনঘটনপটীয়সী। পেশাগত প্রয়োজনে পৃথিবী থেকে মোটামুটি বিচ্ছিন একটা দ্বীপে পরিবার ছাড়া আমাদের আবস্থান প্রায় দুই মাস যাবত। এই বিচ্ছিন জায়গাতে কিভাবে যেন সে ঠিক রাত ১২টা বাজার আগেই অত্যন্ত সুন্দর একটা কেক পৌঁছে দিল। যদিও সুস্বাদু এই কেকটা আরওয়া এর পছন্দ হয়নি, কারণ কেকের রং গোলাপি ছিল না। তথাপি তাহসিন কে অনেক ধন্যবাদ। আমি নিশ্চিত আমি তাহসিনের জায়গায় থাকলে দুর্গম জায়গার অজুহাত দিয়ে নাক ডেকে ঘুমাতাম।
আমার কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীদেরকে আগেই বলে দিয়েছিলাম যে আমার জন্মদিন অমুকদিন। দয়া করে কেউ অযথা কোন হাঙ্গামা যেন না করে। অনুরোধ করেছি, আমার বিশেষ দিনে আমাকে আমার মত থাকতে দেবার জন্য। তাদেরকে ধন্যবাদ যে তারা আমার অনুরোধ রেখেছেন। কিন্তু তাহসিনের পাঠানো কেকতো খেতে হবে। তায় ঠিক করলাম সবাই মিলে কাটবো, এবং অবশেষে আমরা সবাই মিলেই কাটলাম নদীর ধারে যেয়ে। ভালোই লেগেছিল বিকেলটা। (পুনশ্চঃ যখন এই লেখাটি লিখছি, ততক্ষণে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল একটি অতিমানবীয় খেলা খেলে ফেলেছে। ৪৫ রানে ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরও বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আফগানিস্তানকে ৪ উইকেটে হারিয়েছে। অভিনন্দন আফিফ এবং মেহেদি কে। (খেলার বিস্তারিত এইখানে)
মুঠোফোনে অনেক বার্তা এসেছে, ফেসবুকে অনেকে শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন দেশ বিদেশ থেকে। অনেকে ফোন করে, অনেকে সামনা সামনি জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আরেকটা বলবার মত ব্যাপার হয়েছে; আমাদের কর্মক্ষেত্রে আমরা সবাইকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানর একটা রীতি চালু করেছি। আজ আমার সহকর্মীরা সেই রীতি অনুসরণ করে আমাকেও শুভেচ্ছা জানাল। এতসব কিছুর পরও আমার মনটা আজকে অনেক বিষণ্ণ। কারণ তাহসিন, আরওয়া এর মন ভাল নেই। আমি জানি আলিয়াহরও মন ভাল নেই। আরওয়া বুঝতে শুরু করেছে। ও এখন ভাবাবেগে অনেক কিছু বোঝায়। জন্মদিনের সবচেয়ে বড় উপহারটা আজ আরওয়া আমাকে দিয়েছে। সে আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ছবি এঁকেছে, এবং সেই ছবি হাতে নিয়ে ছবি তুলে আমাকে পাঠিয়েছে। কিন্তু তার চোখে মুখে কোন উচ্ছ্বাস নেই, বড় বড় চোখের দৃষ্টি যেন দূরে কোথাও মিলিয়ে যাচ্ছে! আমাকে একটা ভয়েছ ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। আমার সাথে আজকের দিনটা কাটানোর জন্য তার সেকি ব্যাকুলতা!
আমরা অনেক সময়ই বলি যে ‘You always have a choice’। কথাটা সত্যি। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষরা বেশির ভাগ সময় সেই ‘choice’ টাকে অবদমিত করে রাখি। জগত, সংসার এর অনেক কিছু আমাদেরকে ভাবতে হয়, ভাবতে ভাল না লাগলেও। এবং এই ভাবতে ভাবতেই নির্লিপ্ত আমরা একদিন জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে যাই। আমাদের কমলমোতি নিষ্পাপ শিশুরাও ক্রমান্বয়ে আমাদের দ্বারা আবিষ্ট হয়ে আমাদের মতই নির্লিপ্ততা শিখে ফেলে।
আরওয়াদেরকে আমরা কোন ভাবেই এই নির্লিপ্ততা শেখাতে চাই না। ওরা বড় হোক, কিন্তু ভিতরের শিশুরা শিশুই থাকুক। আগামী জন্মদিনে আমরা গোলাপি কেক কাটবো, এবং ইনশা-আল্লাহ একসাথে থাকব।