গাছের সাথে মানুষের তুলনা করলে কি মানুষকে অপমান বা হেয় করা হয়? আমার সঠিক ধারনা নাই। তবে মনে হচ্ছে সমস্যা হবার কথা না, কারণ আমরাতো কথাবার্তার ছলে কতজনকেই কতভাবে গাছগাছালির সাথে তুলনা করি। যদিও কাউকে হেয় করার ইচ্ছা আমার নাই, এবং সেই চেষ্টাও আমি করব না। বরঞ্চ আমি ছোট্ট একটা মানুষের কথা বলবো যে কিনা গাছের থেকেও নির্লিপ্ত, অনুভূতি, এবং ভাবলেশহীন। ছেলেটার নাম ‘চান মিয়া’। গাছ এবং চান মিয়া এই দুই নিয়ে ভাবতে ভাবতে হটাৎই মনে পড়ল আহমদ ছফার ‘পুষ্প, বৃক্ষ, ও বিহঙ্গপুরাণ’ এর কথা। আহমদ ছফা পুষ্প এবং বৃক্ষের যেই বর্ণনা করেছেন, সেই পুষ্প বা বৃক্ষ কারো সাথে চান মিয়ার ভাবলেশহীনতার বিষয়টা তুলনা করলে অবশ্য ব্যাপারটা একেবারে বেশি গড়বড় হয়ে যাবে। যদিও আলমগিরের নির্লিপ্ততার সাথে ছেলেটার একটা মিল আছে।

আজকে বৃহস্পতিবার। পরিবারের কাছে যাওয়ার কোন পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু একটা সুযোগ পেয়ে আর হাতছাড়া করলাম না। মা এবং তাহসিনরা আমাদের একজন ফুফাতো ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছে, এবং জায়গাটা চর বাটা হতে কাছেই। সময়ের হিসেব করে তাহসিনরা মেঘনার অপর প্রান্তে আসলো, আর আমি নদী পার হয়ে কাঁটাখাল গেলাম। যদিও এক ঘণ্টা সময় কাটানোর সুযোগ ছিল, কিন্তু পরিস্থিতির কল্যাণে সময়টা দুই ঘণ্টা হয়ে গিয়েছিল।

দুই ঘণ্টা সময় কাটানোর পরও মনে হচ্ছিল আরেকটু থাকা গেলেতো ভালোই হত। যাই হোক, নৌকাতে উঠতে উঠতে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল। আমাদেরকে বিদায় দিয়ে তাহসিনরা নদীর পার থেকে দৃষ্টিসীমার বাইরে যাওয়ার আগেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। আমরা মেঘনা নদীর পানি আর কুয়াশা মিশ্রিত অন্ধকারকে হুহু করে কেটে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে গন্তব্যে ছুটে যাচ্ছিলাম। নৌকায় আমি, সোহেল এবং হাবিব সাহেব। আর আমাদের নৌকা চালাচ্ছে রুবেলের ভাই আরেক সোহেল, এবং সোহেলের সহযোগী হচ্ছে চান মিয়া। এক সাক্ষাত বিস্ময় চান মিয়া। আবেগ, অনুভূতি, এবং কথাবার্তাহীন এক আশ্চর্য মানুষ এই চান মিয়া।

ঐ শীতের অন্ধকারে ঠাণ্ডা বাতাসের মাঝে জ্যাকেট পরেও আমরা যখন বাতাস এবং ঠাণ্ডায় কাঁপছিলাম, তখন চান মিয়া কিভাবে যেন শুধু একটা লুঙ্গি কাছা মেরে খালি গায়ে অবলীলায় নৌকায় বসে ছিল এবং একটু পর পর পানি সেচে নৌকার বাইরে ফেলছিল তা আমার চিন্তার বাইরে (নীচের ছবিগুলো আজকের নয়, অন্যদিনের)। গত চার সপ্তাহ যাবত প্রতি বৃহস্পতিবারেই আমাদের দেখা হয়, লুঙ্গি ব্যাতিত মাঝে মাঝে একটা ছেড়া জামা ছাড়া আমি ওর গায়ে আর কোন জামা দেখিনি, যদিও বেশির ভাগ সময়েই সে শুধু লুঙ্গি পরেই কাজে বেরিয়ে পড়ে। যতবারই আমাদের দেখা হয়েছে ওকে কোন না কোন ভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। একবার জামা দিয়েছি, একবার একটা নতুন কম্বল দিয়েছি, মাঝে মাঝে টাকা দিয়েছি যেন কিছু কিনে নেয়। কিন্তু ওর খালি গায়ের উপর সে কিছুই জড়াতে চায় না। হয়ত ওর আরও বড় কোন প্রয়োজন আছে, কিংবা জামা না পরে থাকতে থাকতে হয়ত জামা পরতেই ওর অসহ্য লাগে!

আশ্চর্য এই ছেলেটার ব্যাপারগুলো। ওকে ডেকে নাম জিজ্ঞেস করলে ও দৌড়ে পালায়। নৌকার উপড়ে কিছু জিজ্ঞেশ করলে আরেক দিকে মুখ লুকায়। ডেকে কিছু দিতে চাইলে ভয় পায়। যতবার যা কিছু দিয়েছি, জোরজবরদস্তি করেই দিতে হয়েছে। আমার অবাক লাগে, পৃথিবীর পথে এই পথচলায় কত অল্প সময়েই সে কতবড় একজন যোদ্ধা হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে অবাক লেগেছে স্নেহ, আদর, ভালবাসার প্রতিও ওর উদাসীনতা। হয়ত ও এই বৃত্তি গুলোর সাথে পরিচিত নয়, কিংবা হয়ত এই বৃত্তিগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে কোন তীব্র তিক্ত স্মৃতি।

অন্ধকারের পথগলে কিভাবে যে আমাদের মাঝি সোহেল নৌকা চালাচ্ছিল আমি জানি না। আমার মনে হচ্ছিল গুগলও হয়ত এই অন্ধকারে দিক্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যেত। সত্যি খুবই অবাক লাগে নদীপাড়ের এই মানুষদেরকে জীবন কত অসীম শিক্ষায় শিক্ষিত করে দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোন বিকল্প নাই। কিন্তু জীবন থেকে নেওয়া সোহেল আর চান মিয়াদের শিক্ষা কোন প্রতিষ্ঠান, গুগল, কিংবা ইউটিউব কেউই দিতে পারবে না। নীরবে ভাবছিলাম যে আমরা তো কত ফিউশন নিয়েই কাজ করি! কেমন হত যদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে এই মানুষগুলোর জীবন থেকে নেওয়া শিক্ষার একটা ফিউশন করা যেত! এতসত ভাবতে ভাবতে হটাতই খেয়াল করলাম যে আমরা একেবারে মাঝ নদিতে অনেক ঢেউয়ের মাঝে। নৌকাটা দুলছে, আর নৌকার দলুনিতে আমরাও দুলছি। আমি নিজেকে একটু ঠেলে দিয়ে আকাশের পানে চেয়ে নিজেকে তারার মাঝে সমর্পণ করলাম। মনে হচ্ছিল অন্ধকার ছিঁড়ে তারাগুলো টুপটাপ আমার উপর পরবে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ইঞ্জিনটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাসতে থাকি। কিন্তু হাবিব সাহেব যেভাবে দোয়া ইউনুস পড়ছিল, আমি ভেবে দেখলাম এমন একটা কাজ করে আমার খায়েশ যতটুকুই মিটুক, হাবিব সাহেবের কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। অগত্যা, কান ঝালাপালা করা ইঞ্জিন এর শব্দের মাঝেই প্রকিতিটাকে গিলে গিলে খাচ্ছিলাম।

প্রকৃতি গিলে খেতে খেতেই টিপ টিপ কিছু কিছু ছড়ানো ছিটানো মাছ ধরার নৌকার আলো দেখে বুঝলাম আমরা তীরের কাছাকাছি চলে এসেছি। এবং একটু পরেই এক চুলও ভুল না করে সোহেল যেখানে দিনের আলোতে আমাদেরকে নৌকায় তোলে এবং নামায় ঠিক সেখানেই আমাদেরকে নামানোর জন্য নৌকা ভেড়াল। সত্যি বিস্ময়কর। কিভাবে যে জীবন যুদ্ধের এই সৈনিকরা নিজেদের মধ্যে গুগল ম্যাপটা ইন্সটল করে নিয়েছে, সেটা নিয়ে বিশদ গবেষণা করা যেতে পারে।

অবশেষে আমরা নামলাম, এবং সোহেলের পাওনা টাকা বুঝিয়ে দিলাম। চান মিয়াকে ডাকলাম ওর বকশিশ দেওয়ার জন্য। কিন্তু চান মিয়াতো সহজ মানুষ না। অগত্যা জোর করেই যা দেবার দিতে হল। সব মিটমাট করে আমরা আমাদের গন্তব্যস্থানে ফিরার জন্য প্রস্তুত হলাম আর চান মিয়ারাও আবার নৌকায় উঠে পরল। ভাবতেই অবাক লাগছে আবার সেই গুট-গুটে অন্ধকারের মাঝে নৌকা চালিয়ে ওরা ওদের বাড়িতে ফিরবে। অন্ধকারকে ভয় পায়না এমন কোন মানুষ নাই, কিন্তু জীবন যুদ্ধে হার না মানা এই সৈনিকরা ভয়কে জয় করেছে অনেক অনেকদিন আগেই। মনে মনে ওদের জন্য দোয়া করলাম যেন ওরা নিরাপদে ফিরে যেতে পারে ওদের গন্তব্যস্থলে। নিশ্চয় ওদের প্রিয়জনরা ওদের পথচেয়ে বসে থাকবে। দোয়ার পাশাপাশি আরেকটা বিষয়ে মনস্থির করলাম যে এরপর যখনই ঐ পাড়ে যাব রুবেল-সোহেল এবং চান মিয়ার বাড়ি যাব। ওদের জীবন যুদ্ধের বিদ্যাপীঠের প্রথম শ্রেণীর শ্রেণীকক্ষটা দেখতে চাই।

একজন অনুভূতিহীন গাছমানব - সুবর্ণচরের বিস্ময় 'চান মিয়া'
একজন অনুভূতিহীন গাছমানব – সুবর্ণচরের বিস্ময় ‘চান মিয়া’
Subscribe To Our Newsletter

Subscribe To Our Newsletter

Join our mailing list to be the first to know our dreams and thoughts

You have Successfully Subscribed!