
‘যদ্যপি আমার গুরু’ – আমাদের একজন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন
রাজ্জাক সাহেব আহমদ ছফা কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পড়ার সময় দরকারি অংশ টুইক্যা রাখার অভ্যাসটা করছেন কি না?’ আহমদ ছফা চুপ করে বুঝালেন যে তিনি টুইক্যা রাখেন নাই। রাজ্জাক সাহেব বললেন, ‘তাইলে ত কোনো কামে আইব না। ক্ষেত চষবার সময় জমির আইল বাইন্ধা রাখতে অয়’। যেহেতু আমি গল্প, উপন্যাস, যাই পড়িনা কেন, পড়ার সময় বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ/ চুম্বক অংশগুলো নির্দয়ের মত টুকে রাখি, তাই এক মুহূর্তের জন্য মনে হল রাজ্জাক সাহেবের ছাত্র হলে আমার শুরুটা খারাপ হতোনা।
‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইটা সংগ্রহ করেছিলাম ২০০২/২০০৩ সালের দিকে। আর পড়লাম ২০২২ সালে। সে হিসেবে বইটা পড়তে সময় লেগেছে মাত্র ২০ বছর। মহাজাগতিক ঘটনাবলির হিসেব নিকেশে ২০ বছর অত্যন্ত নগণ্য হলেও মানব জীবনে ২০ বছর অনেক বড় একটা সময়। তারপরও, বইটা পড়তে ২০ দিন লাগুক আর ২০ বছর লাগুক, অবশেষে বইটা পড়া হয়েছে সেটাই বড় কথা, এবং আমি অত্যন্ত আনন্দিত। কিন্তু আমার খারাপ লাগছে এটা ভেবে যে, এই সমাজে কি একজন মানুষও ছিলনা, যার উচিত ছিল এই বইটা পড়বার জন্য আমাকে, বা আমাদেরকে কিংবা আমাদের সময় এর তরুণদেরকে বলা, একটু তাগিদ দেয়া? কত মানুষইতো কত কত বই পড়তে বলেছে। কিন্তু কেউ কখনও ‘যদ্যপি আমার গুরু’ পড়তে বলেনি কেন? আমার গুরুজন, মান্য গণ্যদের মন খারাপ করার দরকার নাই। কারণ আমি জানি এবং মানি যে একটি আঙ্গুল দিয়ে অন্যকে দোষারোপ করতে গেলে তিনটি আঙ্গুল নিজের দিকেই থাকে।
আমাদের তারুণ্যে আমরা অনেকটা সময় বই পড়ে কাটিয়েছি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, শরৎচন্দ্র, সমরেশ, শীর্ষেন্দু থেকে শুরু করে কত লেখক/লেখিকারইতো বই পড়েছি। এমনকি শেক্সপিয়ার, ভিক্টর হুগো, নিকলাই অস্ত্রভস্কির লেখাও পড়েছি। সেবা প্রকাশনীর বই পড়েনি এমন মনে হয় একটি মানুষও পাওয়া যাবেনা। আর হুমায়ুন আহমেদ এর বইয়ের ভিতর বুঁদ হয়ে আমাদের অনেকেরই রাত গড়িয়ে সকাল হয়ে যেত। যদিও সেই বুঁদ হয়ে যাওয়ার আমার নেশাটা কিছুদিনের মধ্যেই মিলিয়ে যায়, উনার লেখার প্রখরতা মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে। কিন্তু কিভাবে যেন আহমদ ছফা বাদ পড়ে গিয়েছিলেন। হয়ত তাকে ধারণ করার যোগ্যতা তখনও আমাদের হয়নি।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক কিংবা মৌলবি আহমদ ছফা দুজনের কাউকে নিয়েই লেখার যোগ্যতা বা জ্ঞান কোনটাই আমার নাই। আর সে জন্য আমিও অহেতুক ভুল চেষ্টাও করব না। আমার লেখাটা মূলত হচ্ছে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ আমার কেমন লাগল এবং আমাকে কতটুকু প্রভাবিত করল, সেই ব্যাপার গুলো নিয়ে।
বইটা পড়তে পড়তে আমি হটাৎ খেয়াল করলাম যে আমি অর্ধেকের বেশি পড়ে ফেলেছি। ভাবলাম, বইটা শেষ হলেইতো রাজ্জাক সাহেব, আহমদ ছফা, এবং আমার আড্ডাটা শেষ হয়ে যাবে। যেই ভাবনা সেই কাজ, সাথে সাথেই পড়া বন্ধ করলাম। ছোটবেলায় যখন গল্পগুচ্ছ পড়তাম, আমি কখনওই একদিনে দুই গল্প পড়তাম না। গরু যেমন যাবর কাটে, আমিও একটা গল্প পড়ে কয়েকদিন সেই গল্পের আনন্দ/ ভালোলাগা কিংবা কষ্ট/ বেদনা নিয়ে যাবর কাটতাম। মনে আছে, কিছু কিছু সময় পড়তে গেলে দিনরাত সব ভুলে সমাপ্তিটা জানার ব্যাকুল আগ্রহে, পড়া শেষ করতাম। সেই হিসেবে পড়া বন্ধ করে বসে থাকাটা আপাতদৃষ্টিতে পাঠককে ধরে রাখতে লেখকের অপারগতা মনে হলেও, পাঠক হিসেবে আমি মনে করি এখানে লেখকের সার্থকতা বহুগুণ বেশী। আমরা মাঝে মাঝে যখন স্বপ্ন দেখি, আবার স্বপ্নের মাঝেই চিন্তা করি, ঈশ এই স্বপ্নটা যেন শেষ না হয়। ঠিক তেমনই মাঝে মাঝে কারো লেখা পড়তে গেলে এমনটা বোধ হওয়া নিঃসন্দেহে লেখকের অলৌকিক ক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ।

অবশেষে কয়েকদিন যাবর কাঁটার পর, এবং বেশ কিছুদিন লাস্কি, বদরুদ্বীন উমর, মোহিত লাল, ডঃ রওনক জাহান, জওহরলাল নেহেরু, কিসিঙ্গার সাহেবসহ অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে গবেষণার পর আবার পড়া শুরু করলাম। বলে নেয়া ভাল মাঝখান দিয়ে স্ত্রতস্কি এর ‘থিওরি অফ পার্মানেন্ট রেভুলিশন’ আর তার সাথে স্তালিনের ঝামেলাটা কি হয়েছিল, এবং তিনি কেন মেক্সিকোতে পলায়ন করেছেন, আর স্তালিন তাকে কিভাবে হত্যা করেছিল সেসব বিষয়েও বিস্তর গবেষণা হয়েছে। তবে ভাগ্য ভাল যে রাজ্জাক সাহেব এবং মৌলবি আহমদ ছফা দুইজনের কারোই গবেষণার মত আমার বইটা পড়া একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। যদিও ভয় ছিল দিক হারানোর। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে দিক হারাইনি। শুধু একটাই আফসোস, কেন আমি আমার ১৮/২০এ বইটা না পড়ে ২০ বছর পর আমার ৩৮এ পড়লাম!
আমি নিশ্চিত, আপনি যদি এই লেখার এইটুকু পর্যন্ত পড়ে থাকেন তাহলে বুঝতে পারবেন, বইটা আমার কেমন লেগেছে। বইটা আমাকে এতোটাই প্রভাবিত করেছে যে, আমি ইতিমধ্যেই এই বইতে যত লেখক, সাহিত্যিকের ও তাদের সাহিত্য কর্মের নাম এসেছে এবং তাদের যেগুলো বাজারে অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে তার বেশির ভাগই কিনে নিয়েছি। বাকিগুলোও খোঁজা শুরু করেছি। পাশাপাশি রকমারি এবং নানাবিধও অনলাইন কোম্পানি যারা বই বিক্রি করে, তাদের কল্যাণে রাজ্জাক সাহেবের উপর লেখা লভ্য সকল বই সংগ্রহ এর ব্যবস্থা হয়েছে, এবং সেগুলো অচিরেই এসে পৌঁছাবে। ছোট্ট এই বইটা আমার অনেক কিছুই গড়বড় করে দিয়েছে। এমনকি গুগল ও ইউটিউব আমার অতীত খোঁজাখুঁজির প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করে যেভাবে পরবর্তী কি খাওয়াবে সেটা ঠিক করত, সেখানেও বিশাল গড়বড় লেগে গিয়েছে। কারণ আমার বর্তমান খোঁজাখুঁজি আর নিকট অতীতের খোঁজাখুঁজির মাঝে বিস্তর ফারাক।
‘যদ্যপি আমার গুরু’ আপনার কেমন লাগবে জানিনা। বইটা পড়ে আপনি বিশেষ পুলকিত নাও হতে পারেন, আবার আমার মত উতালা হয়ে যেতে পারেন। আমি জানি এবং একশত ভাগ মানি যে আমাদের একেকজনের চিন্তা ভাবনা, ভালো লাগা, মন্দ লাগা, জীবন, সমাজ, ইত্যাদির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম। আমার এই লেখা পড়ে আপনি যদি উৎসাহী হয়ে বইটি পড়েন কিন্তু আমার সাথে একমত না হন, দয়া করে আপনার সময় ক্ষেপণের জন্য আমাকে মন্দ বলবেন না। আগেই স্বীকার করে নিচ্ছি, আমি যখন কাউকে/ কোন কিছুকে ভাল বলি, মনের সব কিছু উজাড় করে বলি। আমি বিশ্বাস করি, নিঃস্বার্থভাবে কাউকে ভাল বলতে পারা, কোন কিছুর তারিফ করতে পারা, ৯৯% খারাপের পরও ১% ভাল খুঁজে বের করতে পারার ক্ষমতা চাট্টিখানি কথা না।